এক সন্ধ্যা

মার মেডিকেল চেম্বার হাওড়া নদীর বাঁধের ওপার এক ছোট্ট শহরে ছিল। কলেজের ছুটিতে বাড়িতে এসে বাবা-মার সাথে আমিও জেতাম প্রতি সন্ধ্যা সেই শহরে। মাকে চেম্বারে ছেড়ে, বাবা আর আমি জেতাম ইভনিং ওয়াকে।


এমনই একদিন বাবার সাথে ইভনিং ওয়াক করতে করতে আমরা পৌঁছলাম ইন্দ্রনগরের নদীর ধারে এক গ্রামে। নদীর স্নিগ্ধ বাতাস সমস্ত গ্রামে এক মনোহর আবহাওয়া সৃষ্টি করছিল। সেই নদীর পারে সরু পথ ধরে চলতে চলতে এক বাড়ি থেকে শঙ্খ ঘন্টার ধ্বনি শুনতে পারলাম।কৌতূহল বসত আমরা এগিয়ে গেলাম সেই বাড়ির দিকে।

প্রচুর জায়গা ঘেরে সেই বাড়ি। বড় উঠানের তিন পাশে দুতলা বাড়ি। বাড়িটি খুব একটা নতুন নয়। এক দিকে বড় গেট, খুলা ছিল। বাবা আর আমি ঢুকে গেলাম। ঢুকতেই দেখি উঠানের এক দিকে একটি সুন্দর মন্ডপ। সেই মন্ডপে এক দেবীর আরতি হচ্ছে। শঙ্খ-ঘন্টা, ঢাক-ঢোল বাজছে, গারগোল-ধূপের ধুয়া আর উলূধ্বনি চারিদিক যেন পবিত্র করে তুলছে।

প্রধান দেবী মূর্তিটি লাল শাড়ি পরা এক দয়ালু মায়ের চেহরা, রাজহংস বাহন, অষ্ট নাগের সিংহাসন। পায়ে নিচে পদ্মফুল। মায়ের চার হাত - অভয় মুদ্রা এবং কারনা মুদ্রা দিয়ে ভক্তদের মঙ্গল প্রদান করছেন। 
এই দেবীর দু পাশে আরো দুজন করুণাময়ী দেবী মূর্তি।

বাবা বললেন, "অষ্ট নাগের সিংহাসনে বসা - ইনি তো মা মনসা - আর দু দিকে তাঁর সখি নেতা ও সুগন্ধা। মনসা মায়ের মূর্তি পুজো সচরাচর দেখা যায় না।" 
আগ্রহী হয়ে বাবা উপস্হিত এক মধ্যবয়স্ক ভদ্রলোককে জিজ্ঞেস করলেন, "কার বাড়ির পূজা এটা?" 
লোকটি বললেন, "নমস্কার স্যার, আমার নাম নীলমণি রায়। প্রতি বছর এই সময় আমার বাড়িতে মনসা দেবীর পূজা হয়। আমাদের মা খুব জাগ্রত, আমরা মায়ের ভক্ত।"
বাবা বললেন, "মায়ের মূর্তি পূজা এই অঞ্চলে দেখা যায় না।" 
নীলমনি রায় বললেন, "হ্যাঁ স্যার, এর এক কাহিনী আছে। আমার দাদু এই পূজা শুরু করেছিলেন।"
আমি বললাম, "কি কাহিনী ?"
"আমি বলছি।....কানু, তিনটা চেয়ার টান, আর চা বানাতে বল। মায়ের প্রসাদ এখানে নিয়ে আসবি।"
কানু চেয়ার এগিয়ে দিতেই, নীলমণি রায় বললেন, "তুমি বস, স্যার বসেন।" একিসাথে একটি মেয়ে চা নিয়ে এল - যেন সে আগেই জানত এই কাজটা করতে হবে। 

চায়ে চুমুক দিয়ে নীলমণি রায় শুরু করলেন, "আমার দাদু, মধুসূদন রায়, এই গ্রামের এক ব্যাপারী ছিলেন। গ্রামের ব্যাপারী, অভাব ছিল না, প্রাচুয্যও ছিল না। চিকিৎসা ক্ষেত্রে ব্যবহার হয় এমন অনেক জরিবুটি আর আধুনিক ঔষধেরও ব্যবসা করতেন। এক বছর বর্ষা কালে প্রচন্ড বৃষ্টি হল। হাওড়া নদী বুক ফুলিয়ে, পার ভেঙে, গ্রামে, শহরে ছড়িয়ে গিয়েছিল। মহাবন্যা। চারিদিকে শুধু নদী। লোকজন ঘর-দ্বার হারিয়ে বড় মন্দিরে অথবা স্কুলে স্থান খুঁজছিল। অবিরল বৃষ্টি হয়ে চলেছিল। অন্যান্য গ্রাম ও শহর থেকে আসা-যাওয়ার সব পথ বন্ধ। এমন একদিন শুনা গেলো মন্দিরে আশ্রিত শিশুদের জ্বর ও পেট খারাপ হয়েছে। ওষুদের কোন ব্যবস্থা নেই, হাসপাতাল যাবার কোন উপায় নেই। 

মধুসূদন রায়, খুব সহৃদয় ব্যক্তি ছিলেন। ওষুধের ব্যবসা করতে করতে তিনি চিকিৎসা মুলক কিছু জ্ঞান অর্জন করেছিলেন। শিশুদের শরীর খারাপের কথা শুনতে পেয়ে তিনি নিজেই ঔষধ নিয়ে যাবেন ঠিক করলেন। তাঁর কাছে একটি নৌকো ছিল। অন্য কাওকে দুর্যোগের মুখে না ফেলে, তিনি একাই বেরিয়ে পড়লেন ওষুধ নিয়ে মন্দিরের দিকে। কিন্তু বেরোতে বেরোতে সন্ধ্যা হয়ে গিয়েছিল। ঝড়-বৃষ্টি আরও বেড়ে উঠেছিল। নদীর জলে, সমুদ্রের মতন ঢেউ উঠছিল। অন্ধকারে দূরে মন্দিরের আলো দেখতে পেয়ে তিনি নৌকা সেই দিকে এগিয়ে গেলেন। হঠাৎ এক বজ্রপাত হয়ে এক বড় গাছ পড়ে তাঁর নৌকো উল্টে যায়। এক হাতে ওষুদের বাক্স ধরে, তিনি সাঁতার কাটার চেষ্টা করলেন, কিন্তু জলের প্রবাহ খুব শিগগির তাঁকে কাবু করে নেয়। 

সেই জলের মধ্যে কে যেন তাঁকে তুলে ধরল এবং নৌকোতে উঠাল। ওষুধের বাক্স তার হাতে দিয়ে,দাদু অজ্ঞান হয়ে পড়লেন। যখন তাঁর জ্ঞান ফিরল তখন তিনি বাড়িতে। ঝড়-বৃষ্টি শেষ। গ্রামের লোকেরা তাঁকে ধন্যবাদ জানাতে বাড়ি এল। তিনি জিজ্ঞেস করলেন, "বল তো, কি হল?" 
"বাবু, আপনার নৌকা আর আপনার ওষুধের বাক্স নিয়ে দুজন যুবতী মন্দিরে এসেছিল। শিশুদের ওষুধ দিয়ে, সেবা করে তারা তাদের ঠিক করল। আরেক যুবতী আপনাকে অজ্ঞান অবস্থায় বাড়ির দ্বারে রেখে চলে যায়। বাড়ির লোকেরা অনেক খোঁজ করেও তাকে পায় নি। আমরা সবাই এখন আবার বাড়ি ফিরে যাচ্ছি। অনেক ক্ষতি হয়েছে কিন্তু ঠাকুরের কৃপায় কোনো জানহানি হয় নি।"

দাদুর আবছা-আবছা মনে এলো, তন্দ্রায় যেন তিনি সেই তিন যুবতীদের দেখেছিলেন। চোখ বুজে মায়ের চেহারা দেখা দিল। জোর হাতে তিনি মাটিতে বসে পড়লেন। সেই বছর প্রথম বার আমাদের বাড়িতে মনসা মার পূজা হয়।
ঠিক জেই রূপে দাদু তাঁকে দেখেছিলেন - সাথে তাঁর সখি জারা তাঁর সাথে আমাদের রক্ষা করেন।

তারপর আমাদের গ্রামে অনেক উন্নতি হয়। দাদুর ব্যাবসায়ও অনেক লাভ হয়। আমরা কিন্তু প্রত্যেক বছর এই পূজা টা করি। মা আমাদের খুবই প্রিয়।"

এই বলে নীলমণি রায় তাঁর ঘড়ি দেখে বলল, "কি রে, প্রাসাদ কোথায়?" 
বাবা আর আমি উঠে পরলাম। আমি বললাম, "আমাদের ফেরত যেতে হবে। মা কে চেম্বার থেকে পিক-আপ করতে হবে।"
তিনি বললেন, "উনি কি ইন্দ্রনগর শহরে রোগী দেখেন? আমাদের ওষুধের দোকান ঠিক সেই মেডিকেল চেম্বারের পাশে। গরীবদের আমরা বিনামূল্যে ওষুধ দিই।"
প্রসাদের প্যাকেট হাতে ধরিয়ে, তিনি আবার আসার আমন্ত্রণ জানিয়ে আমাদের বিদায় দিলেন। আমরাও তাঁকে এই অপূর্ব সন্ধ্যার জন্য ধন্যবাদ জানালাম।

আবার সেই নদীর ধারে পথ ধরে বাবা আর আমি শহরের দিকে রওয়ানা হলাম। নদীর জল এবং তার আসে-পাশে দেখে মনে হল যেন সেই মঙ্গলকরিনী, অভয়দাত্রী দেবী আমাদের দিকে তাকিয়ে আছেন।

Comments

Popular posts from this blog

In search of a peacock feather

A strange beckoning