এ কি রহস্য !!


শারদত্সবের আমেজে মোহন দাদা মেতে উঠেছিল। নিজের দৈনন্দিন কাজের ফাঁকে এই কয়টা দিনে সে দুর্গাপূজার আয়োজন এবং অনুষ্ঠানে যোগদান দিয়ে সমস্ত কিছু আমোদ প্রমোদে ভুলিয়ে দিত। পূজোর শেষে শারদীয়া যাত্রাপালা দেখা তার বাত্সরিক রীতি ছিল। প্রত্যেকবারের মত এইবার ও সন্ধ্যারতির শেষে মোহন দাদা ও তার বনধু সাইকেল বের করে যাত্রা দেখতে রওয়ানা হল।



"যাত্রা অনেক রাত অবদি চলবে, একটা চাদর নিয়ে নেওয়া যাক। শেষরাতে বেশ কূয়াশা হয়ে যায়।" - এই বলে মোহন দাদা ও তার বনধু দুটো চাদর নিয়ে সাইকেল চেপে রওয়ানা হল।

শারদীয়া যাত্রাপালা এবার "রক্তবীজ বধ" -এর উপর ছিল। কি করে যে সারাটা রাত কেটে গেল বোঝাই গেল না। মোহন দাদা ও তার বনধু মোহাচ্ছন্ন ভাবেই বাড়ি ফেরা শুরু করল। মা মহামায়া কি করে কালিকা রূপ ধারণ করেন এবং তাঁর জিব্ভা বিশ্ব বিস্ত্রিত করে বিন্দু বিন্দু করে রক্তবীজের শেষ বিন্দু রক্ত পান করে তাকে নিঃশেষ করেন এই গল্পই মনের ভেতর আলোডন সৃষ্টি করছিল। মা মহামায়া সেদিন কালরাত্রি রূপ ধারণ করে বিশ্বব্রহ্মাণ্ডকে সম্মোহিত করে রাখেন। শুক্লা সপ্তমী তিথি থাকা সত্বেও সেই রাত্রি তমসাচ্ছন্ন হয়ে যায়।

রাত গভীর। বনধুর বাড়ি পাশের গ্রামে।তাকে বাড়ি ছেড়ে মোহন দাদা নিজের বাড়ির রাস্তায় অগ্রসর হল। সাইকেল চালাতে চালাতে হঠাট পেছন থেকে যেন একটা তান পড়ল। একটু এগিয়ে যেতেই সাইকেলের চেন খুলে গেল।

"এই সময় চেন ঠিক করার উপায় নেই। বাড়ি খুব একটা দুরে না। সাইকেলটা নিয়ে পায়ে হেটে চলা শুরু করি। কাল সকালে সাইকেলের অবস্থা ভাল করে দেখা যাবে।" - এই ভেবে মোহন দাদা পায়ে হাটা শুরু করল।

কিছু দূর হাটার পর মোহন দাদা হঠাট একটা হালকা ছন ছন আওয়াজ পেয়ে থমকে দাঁড়াল। আওয়াজটা মনে হল ঠিক তার পেছনে, কিনতু পেছন ফিরে কিছুই দেখতে পেল না। আবার সোজা রাস্তায় তাকিয়ে দেখে একটি শিশু ছেলে তার ঠিক সামনে রাস্তায় দৌড়াচ্ছে। পরনে তার সুধু একটি লেংটি। তার কোমরে যে তাবিজ বাঁধা ছিল তা থেকেই ছন ছন আওয়াজ।

এত রাতে রাস্তায় একা এই অর্ধ নগ্ন শিশুটি কে দেখে মোহন দাদা চিন্তিত হয়ে উঠল । মনে মনে স্থির করল ছেলেটি কে দেকে একটু জিজ্ঞাসা করবে আর তার গায়ে চাদরটা দিয়ে দেবে। কিনতু একটু এগিয়ে যেতে ছেলেটি যেন উধাও হয়ে গেল।চারিদিকে তাকিয়ে মোহন দাদা সেই শিশুটি কে আর খুঁজে পেল না।

ভ্রু কুঞ্চিত করে মোহন দাদা পথ হেঁটে চলল। এমন সময় আবার সেই ছন ছন আওয়াজ!
পেছন ফিরে দেখল আবার সেই ছোট ছেলেটি পথে দৌড়চ্ছে।
"এই কে তুই? দাড়া! কোথায় যাচ্ছিস?"
মোহন দাদা এই কথা বলতেই ফিক করে হেসে ছেলেটি আবার উধাও হয়ে গেল। শুধু তার কোমরে বাঁধা রুপালি তাবিজটা চোখে পড়ল। সামনে ছন ছন আওয়াজ শুনতে পেয়ে মোহন দাদা বুঝতে পারল কোনও এক ফাঁকে ছেলেটি তাকে পেরিয়ে সামনের পথে দৌড়ে যাচ্ছে।

সাইকেল পাশে রেখে, এক জায়গায় দাঁড়িয়ে, পথের দিকে তাকিয়ে, মোহন দাদা ভাবছিল "ছেলেটি  বড় দুষ্টু। এত রাতে একা একা বেরিয়ে কেন যে দৌড়ে চলেছে, কোনও ভয় ডর নাই।
এই নিস্তব্ধ রাতে, মাঝে মাঝে শেয়ালের ডাক ছাড়া আর কিছুই শুনা যাচ্ছে না । হয়ত সে খেলার ছলে আবার এই দিকে আসবে, তখন তাকে একা যেতে দেব না। শেষ রাতে বেশ ঠান্ডা পড়েছে আর তার গায়ে কাপড় ও নেই।"

হাটা শুরু করার পর তার সাইকেলে আবার টান পড়ল। নিচে তাকিয়ে দেখে ছোট ছেলেটি সেখানে বসা। চোখের নিমিষে আবার সেই ফিক করে হেসে উধাও হয়ে গেল।

"এই, থা....ম!!", মোহন দাদা চিৎকার করে বলল।
কিন্তু কে শুনবে? ছেলেটি সেখানে নেই! মোহন দাদা হতবাক হয়ে পথ হাঁটা শুরু করল, হঠাৎ বুঝতে পারল তার সাইকেলের চেন ঠিক হয়ে গেছে। এমন রহস্যময় ভাবে চেন ঠিক হয়ে যাওয়া যে ছোট ছেলেটিরই কার্য্যকলাপের ফল এতে তার কোন সন্দেহ ছিল না।

চারি দিকে সেই ছেলেটির কোন উপস্থিতি না দেখে সে সাইকেলে পাড়ি দিল। বাড়ি আর দূর নয়। খানিক দূর এগিয়ে যেতে বাড়ির কাছে লান্টার্ন নিয়ে লোকজন জড়ো হয়েছে দেখে মোহনদাদা সেদিকে এগিয়ে গেল।

"কি হয়েছে ওখানে ?"
এক জন বলল - "আরে দাদা, জেলেরা বলল একটি মৃতদেহ ভেসে উঠেছে।"
"যাযাবরদের একটি দল এসেছে, কাছেই - তাদেরই একটি বাচ্চা। হয়ত গতকাল রাতে জলে ডুবে মারা গেছে।"

মোহন দাদা ভীড় ঠেলে মৃতদেহটিকে দেখল। ছোট শিশু, শরীর নীল হয়ে পড়েছে। পরনে তার শুধু একটি লেংটি। কোমরে রুপালি তাবিজটা লান্টার্নের আলোয় ঝকমক করছে।

কিংকর্তব্যবিমূঢ়  হয়ে মোহন দাদা বাড়ির দিকে দৌড়ানো শুরু করল। আজ তার সাথে এই কি হল? বাড়িতে ঢুকে সে তার বিছানায় শুয়ে পড়ল। সমস্ত শরীর ঘামাচ্ছন্ন। হাত পা ঠান্ডা। চোখ বুজতেই ছেলেটির ফিক করে হাসি মনে পড়ল - আর তার তাবিজের ছন ছন শব্দ।

সব কিছু আবছা হয়ে উঠল। গায়ে জ্বর, অবশেষে মোহন দাদা তার চিন্তা শক্তি হারিয়ে চোখ বুজল।






Comments

Popular posts from this blog

In search of a peacock feather

A strange beckoning